বোনে বোনে

“কোথায় এখন”?

“দোহা”।

“খেয়েছিস কিছু”?

“এই তো কাঁড়িমণ খেতে দিয়েছিল ফ্লাইটে। এখন আর খেতে পারছি না। চা খেলাম। যতক্ষণ না পৌঁছব তুই এরকম চিন্তা করেই যাবি”?

“কি করি। আফটার অল তুই …খাওয়া পাবলিক। তোকে ভরসা করবার মতো বুকের জোর কি আমার এ জীবনে হবে রে”।

“যাচ্ছেতাই মেয়ে একটা”!

ওপরের বাক্যালাপটি দুই বোনের, যারা হোয়াটস অ্যাপের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ। কি চমৎকার যোগাযোগ রাখা যায় আজকাল সবসময়। টুকুস টুকুস কথা চালাচালি চলে চান্স পেলেই। এই যেমন এই মুহুর্তে এক বোন যাচ্ছে জুরিখ। মন্ট্রিয়ল থেকে অন্যজনের ক্ষণেক্ষণে মনে হচ্ছে এই বুঝি হারিয়ে গেলো মেয়েটা।

আদিখ্যেতা কি ন্যাকামি নয় একেবারেই। বোনটাই তার অসম্ভব প্রতিভাবান।

যুগ যুগান্তর আগের এক শনিবারের সন্ধ্যে। গানের স্কুল শেষে দুই বোনের আকাশ খাই পাতাল খাই দশা।

দমদম ক্যান্টনমেন্টের অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে প্রতিদিনের মতোই গরম গরম শিঙারা কিনেছেন মা, সঙ্গে সতর্কবাণী “ খিদে পেয়েছে বলে নোংরামি করবে না কিন্তু। বাড়ি ঢুকে হাত ধোবার কথা যেন দুজনের কাউকে বলতে না হয়”।

একটা পুরনো হসপিটাল যেটাকে পরে ডাক্তারদের কোয়াটার্স বানানো হয় আমার মামারবাড়িটা ছিল সেইখানে। ফলে বাড়িটাতে সবকিছুই বিশালাকার। এক রান্নাঘরটাকে টুকরো করলে এখনকার দশটা কন্ডো রান্নাঘর অনায়াসে নিঃশ্বাস নিতে পারবে।

আমি যথারীতি বাড়িতে ঢুকে মাইমাকে আজ কি অপূর্ব সঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে আপ্লুত করে ফেলেছিলাম সেই বুলেটিন এক সেন্টেন্সে জানিয়ে দৌড়ে লালঘরে।

দু সেকেন্ড পরেই প্লেটে শিঙারা, হাতে বই।

কিন্তু সেদিনকে অন্নপূর্ণার চেনামুখ তরুণ পাচক পাচিকার মধ্যে রৌদ্ররসের বিনিময় হওয়ার দরুণই হোক কি অন্য যে কোনও কারণে ওরকম ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের ঠিকুজি কুলুজী ভুলিয়ে দেওয়া ঝাল আমার বাকি সন্ধ্যেটাকে একেবারে অন্যরকম করে দিয়েছিল।

ঝালের চোটে চোখ দিয়ে জল ঝরছে ঝরঝর করে কিন্তু গল্পটাও যে দারুণ জায়গায়, এই অবস্থায় বই ছেড়ে উঠে ওই দৈত্যাকার রান্নাঘরে চিনির খোঁজ করবার ক্যালি আমার মায়ের মিউটেটেড ডি এন এ তে কস্মিনকালেও ছিল না।

আর খুঁজবোই বা কেন? হাতের কাছে বোন নামক প্রাণীটি আছে কি করতে? তারও তো একই দশা।

অতএব “সনু, যা না রে। চিনির কৌটোটা নিয়ে আয় না একটু। প্লিজ?”

“এহ! আমি বলে মরে যাচ্ছি এদিকে। এখন নাকি চিনির কৌটো খুঁজতে হবে ওনার জন্য!”

ছোটো থেকেই অসীম ধৈর্য বলে এই সহৃদয় উত্তরেও বিচলিত হই না বিন্দুমাত্র।

“বোকার মতো কথা বলছিস কেন ? চিনিটা তো দুজনেই খাব, তাই নয় কি”?

“তো তুই ই নিয়ে আয় না। সারাদিন শুধু বই পড়ে যায়। শুধু বই পড়ে যায়। মেজপিসি ইজ সো রাইট। পড়ার বই এত মন দিয়ে পড়লে রেকর্ড করে ফেলতে পারতিস”।

এতক্ষণে একটু একটু রাগ হতে থাকে আমার। এ কিরকম অর্বাচীন যে নিজের ভাল বোঝে না? কিন্তু রাগ করলে আবার মহা মুশকিল। কৌটো সন্ধানে যাত্রা করতে হবে অজানার উদ্দেশ্যে।

অগত্যা দাঁতে দাঁতে চেপে সামলে নিই নিজেকে। হু হু করা জিভ থেকে মধু ঝরিয়ে বার করি পরবর্তী বাক্যটা কারণ ওইটার ওপরেই নির্ভর করছে ঘটনার গতিপথ।

“একটা কথা বল সনু। তুই কখনো — খেয়েছিস”?

হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে সনু।

“এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে? মানুষ কখনো … খায়?”

“মানুষ নাই খেতে পারে কিন্তু তা বলে তুই পারবি না কেন? এস্পেশ্যালি এই লালটা যা টেম্পটিং! এমনিই দুর্দান্ত টেস্ট হবে আমি শিওর, আর ওপরে একটু চিনি ছড়িয়ে দিতে পারলে…আহহ”!

কে ধরে রাখবে বোনকে এরপর?

তাই খানিকক্ষণ পরে মা শিউরে উঠে আবিষ্কার করেন এক মেয়ের ঠোঁটের কোণে চিনি মেশানো দুষ্টু হাসি, চোখ বইয়ের পাতায়। অন্যটা একমনে বিরসবদনে লাল মোটাসোটা মোমবাতির টুকরোতে চিনি ছড়িয়ে গলাধঃকরণ করবার চেষ্টায় মগ্ন।

মোমবাতিটাতে সনু সেরকম সুবিধা করতে না পারলেও আমি যে বলেছিলাম “মানুষ নাই খেতে পারে কিন্তু তা বলে তুই পারবি না কেন?” সেটাতে কিন্তু বাড়াবাড়ি ছিল না ছিটেফোঁটাও।

গরমের ছুটির দুপুর। হঠাৎ হন্তদন্ত ঘরে ঢুকলেন দিম্মা।

“হ্যাঁরে… সকালে যে চিঠিটা লিখে টেবলের ওপর রাখলাম, এখন আর দেখতে পাচ্ছি না তো। ভাবছিলাম বুন্তু চেম্বার থেকে ফিরলে বলব পোস্ট করে দিতে। কোথায় রাখলাম একটু দেখবি, সোনা”?

বুন্তু হচ্ছেন ছোটোমাইমা।

আমি, মাইমা, তুলসিপিসি তন্নতন্ন করে বাড়ি তোলপাড় করে ফেলবার পরেও হদিশ মিলল না সে চিঠির।

মাইমা চিন্তিত হয়ে পড়লেন খুব। ফিসফিস করে বললেন আমায় “ কি ব্যাপার বলতো? মায়ের কি স্মৃতিশক্তি খারাপ হয়ে যাচ্ছে? চিঠিটা লেখেনইনি মনে হচ্ছে। ম্যাজিক তো নয়। যাবে কোথায়”?

যতই ফিসফিস করে কথা বলি না কেন, দিম্মার কানে গেছে ঠিক। তার ওপর আবার ভদ্রমহিলা নিজেও ডাক্তার।

“অ্যালঝাইমার্স সেট ইন করছে বলছিস তোরা? কি করে যে তোদের বিশ্বাস করাই নিজের হাতে ইনল্যান্ডে লিখলাম চিঠিটা। এটা ভৌতিক কাণ্ড ছাড়া কিছু নয়”।

চিঠি রহস্য তখনকার মতো স্থগিত রেখে খাওয়া দাওয়া সেরে হোমটাস্ক নিয়ে বসেছি, হঠাৎ কাঁচুমাচু মুখে বোন বললেন “এই শোন না। একটা কথা বলবো তোকে? শত্রুতা করে ডোবাবি না তো”?

আমি চুপ।

“ইয়ে মানে চিঠিটা না আমি খেয়ে ফেলেছি”!

“আমি যে এটা সন্দেহ করিনি তা নয় কিন্তু সবটাই খেয়ে ফেলবি ভাবিনি”।

“আরে নীল রংটা এত ভাল লেগে গেলো”!

বহুদিন পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে জাস্ট জিভ ঠেকিয়ে সনু বলে দিতে পারতো সাবানটা লাক্স না সান্তুর না কি সিন্থল।

সত্যিসত্যি ছোটো যখন ছিল , দেওয়াল চাটাচাটি ছিল ওর প্রিয় খেলা। বলতো “হাতিবুজি” খাচ্ছি।

আজ জুরিখ থেকে প্যারিসে ঢুকেছে।

ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম দুটো ছোট্ট লাইন।

“পৌঁছে গেছি। তোর সময়মত কথা বলব একটু”।

বাইরে থেকে দেখলে কোনও মিল নেই আমাদের দুজনের।

সনু ধীরস্থির। আমি চির ছটফটে।

সবকিছু ঢাকা সুইম স্যুট পাওয়া যায় না বলে সনুর ভাল করে সাঁতার শেখাই হল না, আমার মিনি স্কার্টেও গরম লাগে।

সনু আজন্ম প্রেমে বিশ্বাসী।

এবং ও বিশ্বাস রাখে একদিন আমিও বুঝে যাবো জিনিসটা ঠিক কিরকম।

মিলটা শুধু একজায়গায়।

নাহ। রক্তের কথা বলছি না।

মা বলতেন, “নিজের বুকের ভেতরে যে ডানাটা আছে সেটাকে ভাঙ্গতে দেবে না কখনো। নিজেকে নানাদিকে ছড়িয়ে দেবার চাইতে বেশি আনন্দ আর কিছুতেই নেই। কোনও সম্পর্ক নিয়ে ভাবলে নিজেকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে সবার আগে, তোমার জন্যে সম্পর্কটা নাকি সম্পর্কটার জন্য তুমি। উত্তরটা এড়িয়ে যেয়ো না কোনোদিন”।

কি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম সনুর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে।

“কি হবে? যদি বদলে যায়? হাঁড়ি-বাড়ি-শাড়ির চক্করে মাথাটা ঘেঁটে যায় যদি”?

এখানে একটা খুব বড়ো ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা আছে বলে একটু এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে রাখি। হাঁড়ি-বাড়ি-শাড়ির কোনোটাকেই কোনও অবস্থায় কণামাত্র ছোটো করবার বাসনা আমার নেই।

“ভাল করে সংসার করাটা খুব বড় একটা আর্ট”,মা বলতেন। শুধু বলেননি, প্রমাণ করেছিলেন নিজের জীবনে।

“কিন্তু সংসারের খুঁটিনাটির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেল না। সেখানেও সেই একই কথা। সংসারের জন্য তুমি নাকি তোমার জন্যে সংসার”।

“স্বাধীনতা মানে শুধু পার্টি করা নয়। নিজের অধীন থাকবার চেষ্টাটা থামিয়ে দিও না”।

আমার মনে হয় এইটাই আমাদের সবচাইতে বড় মিল।

পাঁচ বন্ধুতে প্যারিস গেছে সনু। কোর্স করতে। তার আগে জুরিখ ঘুরে দেখেছে।

ডানাগুলো মেলেই থাকতে চাই আমরা। এমন করেই।

 

 

 

 

One Comment

Add yours →

  1. darun hoiche lekhata

    Like

Leave a comment