রং পেনসিল

অগাস্ট মাসটা বড্ড মন কেমনের মাস।

কয়েকদিন আগে পরে মা আর দিদার চলে যাওয়াটা আমি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটা মানুষের জীবনের মানেটাই চিরকালের মতো বদলে দিয়েছে।

সখ করে শোক করবার বিলাসিতা এবং সাহস কোনোটাই আমাদের নেই। ছিলও না।

আমরা তাই আপ্রাণ চেষ্টা করি স্বাভাবিক থাকবার। কিন্তু একটা সময়ের পর কেউ কারুর ফোন ধরতে পারি না, স্কাইপেও চোখে চোখ রাখতে পারি না। আর কিছুক্ষণ পর পরই মনে হয়, একটু একা থাকতে পারলে আর কিছু চাওয়ার নেই।

আজ মা চলে যাওয়ার দিনটাতে দিদার কথা মনে পড়ছে খুব। জানি না কেন।

আমার দিদার নাতি নাতনীর সংখ্যা আট। আমরা ভাই বোনেরা সবাই ফেসবুকে আছি, পেনসিলটাও কেউ এড়িয়ে যায় বলে খবর নেই এখনো পর্যন্ত। তারপরেও ভীষণ দায়িত্ব নিয়ে একটা কথা বলতে পারি- দিদার খুব খুব কাছের ছিলাম আমি।

এটা বলে কিছু প্রমাণ করবার দায় নেই আজ, শুধু মনে হয় কিছু কিছু সম্পর্ক হয়তো সত্যিই জন্মান্তরের।

চাকদার পাট চুকিয়ে দাদু দিদা এসে উঠলেন বি গার্ডেনের ছোট্ট ফ্ল্যাটটায়। পুঁচকে দুটো ঘর কিন্তু তিরিশজন একসঙ্গে হলেও কোনওদিন কারুর কষ্ট হয়েছে বলে শুনিনি।

কোথায় চাকদা আর কোথায় বি গার্ডেন। আমার আনন্দ দেখে কে?

রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে জাস্ট একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে নেওয়া, আজ শ্যামবাজারের মেট্রো ধরে বোরিং বরানগর নাকি পাবলিক বুথ থেকে মাকে একটা ফোন করে ছুট্টে উলটোদিকের সি সিক্সে উঠে পড়া?

আমি আমার বাবা মায়ের কাছে চিরকৃতজ্ঞ যে তাঁরা পড়া আর টিউশন টিউশন বাতিকে নিজেদের এবং আমার জীবন বিন্দুমাত্র ব্যতিব্যস্ত করে তোলেননি। আমাকে কস্মিনকালেও শুনতে হয়নি “সেকি দিদার কাছে? নো ওয়ে! বাড়ি ফিরে পড়তে বস”!

ফাঁকি দিলে নিজেই ফাঁকে পড়বে, এই ছিল ওঁদের ঠোঁটকাটা দর্শন।

আর কলকাতায় আসবার কয়েকমাসের ভেতরেই দাদু চলে যাওয়ায় দিদাকে একা রাখবার প্রশ্নই উঠত না, যদিও সর্বক্ষেত্রে এরকম পারদর্শী বুদ্ধিমান মানুষ আমি আর আর দেখিনি।

মাকে ভয় পেতাম সাংঘাতিক আর দিদা ছিলেন পরম বন্ধু।

কক্ষনো বলে যেতাম না দিদার কাছে। তখনো ফোন আসেনি, আসবো বলে যদি যেতে না পারি সে এক কেলেঙ্কারি। রাত্তির বারোটা অব্দি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন জানলায়, সাতটার পরে আমার আসবার এতোটুকু সম্ভাবনা নেই জেনেও। আর জনে জনে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন রাস্তায় কোনও গোলমাল হয়েছে কিনা!

মায়ের সঙ্গে টুকটাক লেগেই থাকতো কিছু না কিছু নিয়ে, দিদার সাথে একটা জিনিস নিয়েই লড়াই হয়েছে সারা জীবনে।

দাদু চলে যাওয়ার পর নিরামিষ খেতেন দিদা। কিন্তু মাছ ভালবাসতেন খুব, ছোটো থেকে দেখেছি।

আমার একটাই শর্ত ছিল- দিদা যা খাবেন আমিও তাই খাব।

একবার মাসিকে দিয়ে মাছ আনিয়েছিলেন, আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।

“আর কেউ করে না তোর মতো এরকম জেদ। সবাই আসে, মাছ মাংস যাই দিই সোনা মুখ করে খেয়ে নেয়। আমার ভাল লাগে তুই এই ডাল আলুভাজা দিয়ে রোজ রোজ খেলে? বল?”

“আমি অবাধ্য কথা না শোনা একটা মেয়ে জানোই তো। কিন্তু শুধু ডাল আলুভাজা দিয়ে খাই এইটা বোলো না প্লিজ। আইটেম গুনতে গেলে যে কোনও সুস্থ মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে! হি হি তোমার কথা শুনে দেওয়ালটাও কিরকম হাসছে দেখো!”

বাবার কাছে নালিশ করায় জবাব এসেছিলো “থাক না মা। দিদার রান্না নিরামিষ খেয়ে কোনও নাতনীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে বলে কি আপনি শুনেছেন কখনো?”

“যেমন মেয়ে তার তেমনি বাবা”! –ভীষণ রেগে গিয়ে রান্নাঘরের স্মরণ নিলেন দিদা।

ছায়া দেবীর মতো দুখী নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন “যা পারিস করে যা বুড়ি দিদার সঙ্গে। এত জেদ তোর! এমন একজন আসবে তোকে ঘেঁটি ধরে সব শোনাবে, বুঝবি তখন”!

আমি শিওর দিদার এই হাহুতাশ এখনো চলছে। আমার সঙ্গে আবার যখন দেখা হবে তখনো চলবে!

দিদার আরেকটা ভয়াবহ চিন্তার কারণ ছিল বি.ই কলেজের কচি বালকদল, তাদের মধ্যে থেকে দিদার নিষ্পাপ নাতনীর ভক্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল কিনা। ফলো করা , চিঠি এসব তো থাকবেই কিন্তু দুই বন্ধু আবার দস্তুরমত বাড়ি বয়ে দিদার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে জানিয়ে গিয়েছিলো এদের ভেতর একজনকে আমার বিয়ে করতেই হবে। যে কোনও একজন হলেই চলবে। আরেকজন স্যাক্রিফাইস করবে!

দিদার আতংক দেখে কে? বাসস্টপে নিজে আসবেন আর সে ছেলেদের কারুর টিকিটিও নজরে এলে সেদিনের মতো আমার ফেরা ক্যানসেল।

“এহ দিদা! আর কতোবার বলতে হবে তোমাকে এ জীবনে কোনও ইঞ্জিনিয়ারকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দেবার প্ল্যান নেই আমার”?

“আরে তোর প্ল্যানে কি যায় আসে? রাজি না হলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে বলেছে জানিস”?

পাশের ঘর থেকে একটা নিশ্চিন্ত স্বর ভেসে আসে তৎক্ষণাৎ।

“তুলে নিয়ে গিয়ে কিস্যু করতে পারবে না মা। এ মেয়ে যা জিনিস, দুদিন যেতে না যেতেই দেখবে রক্ষা করো বলে বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেছে! আর তোমার নাতনী কোথাকার রম্ভা উর্বশী যে লোকের খেয়েদেয়ে কাজ নেই একেবারে তুলে নিয়ে যাবে”!

“যেমন মা তার তেমনি মেয়ে ”! –ভীষণ রেগে গিয়ে রান্নাঘরের স্মরণ নিলেন দিদা।

কি নিয়ে কথা হতো না আমাদের।

“তোর মাথাটা এত ঠাণ্ডা, তোর বয়সটা মনেই থাকে না আমার। সব সুখ দুঃখের কথা তোর সঙ্গে। দেখিস এখন যেটা বললাম খবরদার মাকে বলে ফেলিস না কিন্তু! খুব মুশকিল হয়ে যাবে”!

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা জানতে পারতেন দিদা আর আমি দুজনে মিলে সমস্যাটা মিটিয়ে নেওয়ার পর।

একটাই কারণ।

আমার মা ভদ্রমহিলা ছিলেন ভয়ংকর স্পষ্টবাদী আর সংসার বেশিরভাগ সময়েই স্পষ্টবাদীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে অক্ষম। অকারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়।

“দিদা প্লিজ! এবার তুমি ঘুমোও একটু। আর কতো হাত বুলিয়ে দেবে মাথায়? রাত ভোর হয়ে যাবে তো!”

“তুই ঘুমোবি? এত পাতলা ঘুম তোর! এক্ষুনি আপদগুলো আসবে আর ঘুমের মধ্যেও চমকে চমকে উঠবি!”

“আহা আপদ বোলো না। ওদের কি দোষ”?

“তা অবিশ্যি”।

বলতে বলতে অন্ধকারেই খিলখিল হেসে উঠি দিদা আর আমি।

পরিস্থিতিটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুতর। হাসবার মতো নয় মোটেই ।

কোনও এক অজানা কারণে মাকে আসমুদ্রহিমাচল কখনো বুঝিয়ে উঠতে পারেনি, যে কোনও চোর কিংবা ডাকাতের প্রাইমারি মিশন হচ্ছে চুরিডাকাতি করা। তারা খামকা অ্যাক্রোব্যাটিক্স করে কারুর খাটের তলায় ঢুকতেই বা যাবে কেন আর একান্তই যদি ঢুকে পড়ে তো সেই মুহুর্তে সেই বাড়িতে সেই খাটের ওপরে মা পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে মায়ের পা ধরেই বা টান মারতে যাবে কেন। খামখা!

বোঝানো যায়নি । তাই প্রতিরাত্রে আমাদের কাউকে খাটের তলায় উঁকি মেরে মায়ের এবং বাড়িতে উপস্থিত বাকি সকলের পায়ের সেফটি কনফার্ম করতে হতো।

কিন্তু সবচাইতে বিপদে পড়তো বেচারা রাতপাহারাদারগুলো।

আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় পদার্পণ করা মাত্রই তাঁরা সবাই এক যোগে কাশতে আর গায়ের সমস্ত জোর একত্রিত করে লাঠি ঠুকতে শুরু করতেন।

একটাই উদ্দেশ্য। মাকে প্রাণপণ জানান দেওয়া “বৌদি দোহাই আপনার! এই দেখুন কিরকম মন দিয়ে পাহারা দিচ্ছি”!

না হলে পরের দিন তাঁদের কপালে যে ঠিক কি নাচছে দেবাঃ ন জানন্তি!

বাবা আর আমি এই যন্ত্রণার সবচাইতে বড় ভিক্টিম। আমাদের আদুরে ঘুম এসব অত্যাচারে পালানোর পথ পেত না।

দিদা অগত্যা একদিন বাধ্য হয়ে পাহারাদারদের ডেকে বললেন “দেখো বাবা, আমি বুড়োমানুষ ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি, একঘুমে রাত কাবার। আমার নাতনীটা এলে অন্তত তোমরা যদি এই ঠকঠকানিটা একটু কম করো। কাল সকালে আবার ইস্কুল আছে কিনা”!

ক্যাপ্টেন পাহারাদার দলের সঙ্গে মিনিটদশেক পরামর্শ করে রায় দিলেন “ঠিক আছে মাসিমা। আমরা লাঠি সামলে রাখবো। কিন্তু নাতনীর মা যেদিন যেদিন থাকবেন একটু আগে থাকতে খবর পাঠিয়ে দেবেন”!

আজ দুপুরে রিঙ্কি বলছিল “তুই কেন এমন করে লিখিস দিদিভাই। মাথাটাই খারাপ হয়ে যায় আমার”।

রোশনি দিও একই কথা বলবে জানি।

কিন্তু এছাড়া যে আমার রাস্তা নেই আর।

ওঁদের কাছে পৌঁছনোর। হলোই না হয় পলকের জন্য।

নাই বা থাকলো শ্যামবাজারের মেট্রো কিংবা সি সিক্স।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

2 Comments

Add yours →

  1. Dipen Bhattacharya August 4, 2015 — 11:09 am

    দিদাকে এত কাছে পাওয়াটাই সৌভাগ্য। আর সেই কাছে পাওয়ার স্মৃতি মনের মাঝে যত্ন করে রেখে দিয়ে নস্টালজিক অক্ষরে পরিণত করাটা এই ব্লগ-কারিগরের কৃতিত্ব।

    Like

Leave a comment