সত্যি হলেও গল্প

এই যে এখন আমি পেনসিলে টুকটুক করে টাইপ করছি সেটার পেছনে কিন্তু খুব স্বার্থপর একটা উদ্দেশ্য আছে। শুনেছি আর পাঁচজনকে শোনাতে পারলে নাকি পরম দুঃখের বোঝাও হালকা হয়ে যায়।

একলা এই অসহনীয় যন্ত্রণা আর সহ্য করা যাচ্ছে না- তাই পেনসিল।

২০১৪ র জানুয়ারির শেষ দিকে কলকাতা গেছিলাম সে কথা পেনসিলে আগেও লিখেছি। যাবার কারণটাও আপনাদের অজানা নয়।

বাবার শেষ না করতে পারা ছড়ানো ছেটানো কাজগুলো একজায়গায় গুছিয়ে আনাটা সহজ ছিল না খুব।  ব্যাংক-কোর্ট আর উকিলের কাছে দৌড়েই কেটে গেল সময়টা।  অনেক কিছু শিখলাম-জানলাম; যে জানাগুলো মাথার ওপর একমাত্র মা-বাবার ছায়াটা না থাকলেই জানা যায়।

বাড়িটা অতো তাড়াতাড়ি বিক্রি হবে না বুঝে মেসোমশাইকে অ্যাবসল্যুট পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিয়ে ভাবছিলাম কবে পালাব। আর ভাল লাগছিল না কিছু। ওটা তো জাস্ট বাড়ি নয়, আত্মার একটা অংশ। বিক্রি করবার আমি কে?

চলে আসব যে শনিবার, সেই সপ্তাহে বুধবার রাত্তিরে উকিল বাবুর ফোন “আরে তুমি কি মন্ট্রিয়লেই থাক নাকি? দ্যাখো কাণ্ড! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ফিরে এসেছ। এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট ছিলে হয়তো। এখন তো একটা এন আর আই অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। খুলতেই হবে। সব গোলমাল হয়ে যাবে না হলে কিন্তু”।

আগের আমি হলে হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চয়ই বলতাম “ আপনার কি এতদিন ভাবসমাধি চলছিল? আর দুদিন পরে বললেই পারতেন। প্লেনের জানলা দিয়ে শুনতাম”।

কিন্তু আড়াইমাস অবিরত লড়ে ভেতরটা এতোটাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে আর নতুন করে যুদ্ধ শুরু করবার প্রবৃত্তি হল না।

“খুলে আপনাকে জানিয়ে দেব” বলে ফোনটা রেখে দিলাম।

এরপর রিসার্চের পালা। ময়ূখে-আমাতে মিলে অনেক মাথা খাটিয়ে, যোগ-বিয়োগ- গুণ-ভাগ  করে অবশেষে পৌঁছলাম এই ব্যাংকটার ডালহৌসি ব্রাঞ্চে। পরের দিন সকালে।

১২ই এপ্রিল ২০১৪।

চিনি বিন কালো কফি খাইয়ে প্রথমেই আমাকে পুলকিত করে ভদ্রলোক জানালেন এই জয়েন্ট অ্যাকাউন্টটা খুলতে ম্যাগি বানানোর চাইতেও কম সময় লাগবে।

ময়ূখের সাথে গর্বিত দৃষ্টি বিনিময় চলে আমার “এহি হ্যায় রাইট চয়েস বেবি”!

মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে উকিলবাবুকে বলে দিলাম “করে দিয়েছি।  নেক্সট দুটো দিন আর নতুন কোনও বায়না জুড়বেন না প্লিজ”।

সন্ধ্যেবেলা দমদমে ছোটমামার কাছে যাচ্ছি, অমনি ফোন।

“ম্যাডাম একটা ভুল হয়ে গেছে। মাইনর মিসটেক। আপনাদের আরও কয়েকটা সই চাই। কি বললেন? আর আসতে পারবেন না? এই গরমে মাথার ঘিলু গলে যাবে?  না না আপনাদের আর আসতে বলছি না। আমিই লোক পাঠাচ্ছি। সাইনগুলো করে ওর হাতে দিয়ে দেবেন প্লিজ। এই ধরুন কাল সকাল  দশটা নাগাদ?  থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। থ্যাঙ্ক ইউ”।

পরের দিন এগারোটায় ক্যুরিয়ার বালকের আবির্ভাব। তাকে একপ্রস্থ সরবত খাইয়ে কাগজের তাড়া সহ বিদায়দান।

মন্ট্রিয়ল ফিরে এসেছি। মাথা থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট- ট্যাকাউন্টের কথা ধুয়ে মুছে সাফ। হঠাৎ ই এক অপুর্ব বার্তা মেলে।

অ্যাকাউন্টটা ওঁরা এখনো খুলতে পারেননি। আমরা মন্ট্রিয়ল থেকে একটা ইলেকট্রিক কি ফোন বিলের স্ক্যানড কপি পাঠালেই ব্যাপারটা হয়ে যাবে। আমাদের আর কোনও  চিন্তা নেই।

আমি তখন একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছি আবার।  তাও অতীব ভদ্র ভাবে জিগ্যেস করলাম “আপনি প্রতিটা জিনিস এরকম ইন্সটলমেণ্টে বলছেন কেন। আপনার কেন এ ধারণা হল যে বিলের স্ক্যানড কপি দিতে হলে আমাকে মন্ট্রিয়লে ফিরতে হবে? এটা তো দুমাস আগেও আমার কাছে ছিল”।

আগে কখনো বুঝিনি কিন্তু সেদিন মনে হল ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই ওকেশনাল তোতলামি আছে। আর আমার সঙ্গে কথা বলবার দরুণ হয়ে থাকলে খুবই দুঃখের কথা।

যাই হোক সেপ্টেম্বারে চেক বই- ডেবিট কার্ড  বাড়িতে এল। আর আমিও সেগুলো গুছিয়ে তুলে  রাখলাম।

এতদূর অব্দি সব ঠিকই ছিল। সামান্য বিরক্তি কিন্তু স্টিল ভেরি মাচ ম্যানেজেবল।

কুরুক্ষেত্রটা শুরু হল বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবার পর। মেসোমশাই ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছেন অ্যাকাউন্টটা অনলাইন দেখাশোনা করবার জন্য।

কিন্তু করব কি করে?

মনে পড়লো তিন মাস আগের লাস্ট মেলটায় যে লেখা ছিল ডেবিট কার্ডের পিন পাঠাচ্ছে পনের দিনের মধ্যে, সেটা তো আসেনি।

আবার ফোন। আবার ও।

বার দশেক ফোনালাপের পরে ওঁরা পাঠালেনও পিন। অ্যাট লিস্ট সেরকমই বলা হল আমাকে।  কিন্ত আমারই দুর্ভাগ্যবশত সেটা আর পৌঁছল না। অ্যাটলান্টিকে বিলীন হয়ে গেছিল খুব সম্ভবত।

দ্বিতীয়বার গলা চড়াতে বাধ্য হলাম। পিনও পৌঁছে গেল আমার কাছে।  মাসখানেক জলে গেল এই যা।

এইবার শুরু হল সদাশিবের “ঘোড়া-ঘোড়া কাণ্ডের” মতো আমাদের “ঘোরা-ঘোরা কাণ্ড”।  আমাদের বলা হয়েছিল যে কোনও একটা এটিএম থেকে কার্ডটা অ্যাক্টিভেট করে নিলেই অনলাইন অ্যাক্সেসের জন্য অ্যাপ্লাই করা যাবে। পিন নাম্বার প্রেস করে করে  ময়ুখের আঙ্গুলে কড়া পড়ে গেল কিন্তু সারা মন্ট্রিয়লের প্রতিটি এটিএম পরিভ্রমণ করেও সে অমূল্যধনকে জাগ্রত করা গেল না।

এবার ফোন করতে ওপাশের মহাশয় জানালেন তাঁদের তরফ থেকে একটা স্লাইট ভুল হয়ে গেছে আবার। আবারও।

ক্লান্ত গলায় বললাম কোনও টাকা পয়সা ওঠাব না, শুধু অনলাইন অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস চাই। ফোন ব্যাঙ্কিং নাম্বার আর পিনটা দিয়ে দিন। আপনারাও বাঁচবেন, আমরাও।

নিত্য এ যন্ত্রণা আর নেওয়া যাচ্ছে না।

দয়াপরবশ হয়ে তিনি ফোন ব্যাঙ্কিং নাম্বারটা দিলেন, সঙ্গে প্রভুত আশ্বাস যে পিনটাও নিজ দায়িত্ব সহকারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এবং এবার সেটা কিছুতেই সাগরপারে হারিয়ে যাবে না।

এটা এপ্রিল ২০১৫ র কথা।

যথাসময়ে ডি এইচ এল জানাল তারা পার্সেল নিয়ে ভিজিটে আসছে, অবশ্যই যেন বাড়িতে থাকি।

কম্প্রবক্ষ আমার খুশি আর ধরে না।  শবরীর প্রতীক্ষার কি মধুর সমাপ্তি।

কিন্তু ডি এইচ এলের তো এরকম খামখেয়ালি আচরণ করবার কথা নয়। আসব বলে এল না?  পরদিন সকালে জানা গেলো, ইন্ডিয়া থেকে পার্সেলটা ফেরত পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে এবং সেই সংস্থার এরকম আজব ব্যবহারের কোনও কূলকিনারাই তাঁরা পাচ্ছেন না বলে আমাদের কাছে  ক্ষমাপ্রার্থী।

শুধু আমার মায়ের জিন থাকলে এ কাজটা অন্তত ছমাস আগে করতাম কিন্তু ফিফটি পারসেন্ট বাবাও আছেন তো ভেতরে তাই একটু ধৈর্যের পরিচয় দিতে চেয়েছিলাম আর কি।

ঠাণ্ডা মাথায় গুছিয়ে তিনটে মেল পাঠালাম, বয়ানটা সামান্য এদিক ওদিক করে।

পরদিন সকাল থেকে যে ফোন শুরু হয়েছে আজও থামেনি।

যে  দক্ষিণী ভদ্রলোক প্রথম ফোন করলেন, তাঁর সবিনয় নিবেদন, “ম্যাডাম করেছেনটা কি? কোথায় কোথায় মেল করেছেন। আমাদের যে এখন কি হবে? এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি সবকিছু। কিন্তু আরেকটু  ধৈর্য যদি ধরতেন। ভগবান! আমাদের এখন কি হবে?”

আমি খুবই বিনম্র গলায় জানালাম “দেখুন এইচ এস বি সি র সঙ্গে অগস্থ্য মুনির কোনও সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু দূর থেকে একবার দর্শন করা ছাড়া আমার সাথে বিন্ধ্য পর্বতের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই তাই আরও একটু  ধৈর্য অনেক চেষ্টা করেও ধরা গেল না”।

“তা বলে চীফ নোডাল অফিসারকে মেল করবেন? ভগবান! আমাদের এখন কি হবে?”

“কেন? ওনার মেল আই ডি টাই তো পেলাম আপনাদের সাইটে। বলেছেন এইচ এস বি সি র ব্যবহারে মনে আঘাত পেলেই জানাতে। আমি তো আপনাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলিনি। শুধু  অ্যাকাউন্টটা ক্যানসেল করতে ওনার সাহায্য চেয়েছি। আমার তো এই মুহুর্তে সেই অধিকারটুকুও নেই বুঝতেই পারছেন। আর  মেল পেয়েই উনি নিজে আমাকে উত্তর দিয়েছেন। খুবই চমৎকার মানুষ বলতে হবে”।

“তার আগেও তো তিন-চারটে  ঠিকানা ছিল ম্যাডাম। আপনি একবারে ওঁকে—? আর দয়া করে কিছু লিখবেন না কাউকে এই মিনতি করছি আপনাকে, আপনার পিন আবার ফেরত যাচ্ছে”- বিড়বিড় করতে করতে থেমে যান বিমর্ষ ভদ্রলোক।

ইতিমধ্যে বাকি দুটো জায়গা থেকেও খোঁজখবর চালু হয়ে গেছে। যে রিলেশনশিপ ম্যানেজার গত এক বছর আমার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি হঠাৎ ওপরওয়ালাদের সি সি করে আমাকে গ্রিটিংস পাঠাচ্ছেন দেখছি, সাথে অবিরাম বাণী “ ডোন্ট ওয়ারী প্লিজ। ইউ আর বিয়িং টেকেন কেয়ার অফ”।

আমারই পাপী মন , পড়লাম যেন বলছে “ দয়া করে আর একে তাকে চিঠি লিখ না”।

ডি এইচ এল কল করেছে একটু আগে। কাল আসবে।

“দিবস রজনী আমি যেন কার আসার আশায় থাকি”-

আবার। আবারও।

 

 

 

2 Comments

Add yours →

  1. ultimately ki holo janash.ader bishash kora jai na kono mote.lekhata besh upobhog korar moto likhachish kintu.

    Like

Leave a reply to Indrani Cancel reply