স্যুটকেস

বছর দশেক আগেকার গল্প এটা।

প্রতিবার দুর্গাপুজোতে আমার সমগ্র মামাবাড়ির জনতা মানে ইনক্লুডিং আমি-মা-বাবা একটা ছোট্ট ট্রিপ সেরে আসতাম। খুব দূরে কোথাও নয় যদিও। প্ল্যান মোটামুটি একইরকম, যাওয়ার জায়গাটা বদলে যেতো শুধু।

নবমী নিশিতে কলকাতা ছেড়ে পলায়ন আর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আগেরদিন গুটিগুটি রিটার্ন।

এই তড়িঘড়ি বেড়াতে যাবার উদ্দেশ্য কিন্তু একটিই। প্রিয়জনের যতোটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা আর প্রাণ ভরে আড্ডা। কিন্তু এতজন মিলে বেড়িয়ে পড়বার অসুবিধাও ছিল বিস্তর। টিকিট এবং হোটেল বুকিং যত্রতত্র যথেচ্ছ ভুগিয়েছে  দলের ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে। আর দাদু দিদা সঙ্গে থাকায় কিছু স্পেশাল কেয়ার তো লাগতোই।

কিন্তু ওই যে কথায় বলে না ‘যে খায় চিনি, যোগান চিন্তামনি” কিংবা “যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় ন জন”- তাই ব্যবস্থা কিছু না কিছু একটা ঠিক হয়েই যেতো।  সর্বোপরি  মাতঙ্গিনী হাজরা স্বরূপা আমার মাতৃদেবীঠাকুরানি বিরাজ করায় কার ঘাড়ে কটা মাথা ছিল বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করবার?

সেবার ফিরছিলাম পুরী থেকে।  হাওড়া অব্দি কোনও ট্রেনে এতজনের ডিরেক্ট বুকিং পাওয়া যায়নি। আর আলাদা আলাদা ফেরবার তো প্রশ্নই ওঠে না। ননস্টপ  হা হা হি হি আর হল্লাটা হবে  কি করে তাহলে?

সে যাই হোক। নীলাচল এক্সপ্রেস তো আমাদের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে খড়গপুরে নামিয়ে ভাগলবা।

ঠিক তারপরেই ছোটো মেসোমশাই ভগ্নদূতের বেশে সংবাদ আনলেন যে লোকাল ট্রেন ছাড়বে ঝাড়া দেড় ঘন্টা পরে আর তার সাথে আরও সাড়ে তিন ঘন্টা  যোগ করলে আমরা টিকিয়াপাড়ার তারের বেড়া ক্রস করব।

বিমর্ষ চিত্তে  প্রায় অচল বডিটাকে টেনে টেনে চোখ বন্ধ অবস্থায় সবে একটা ফাঁকা বেঞ্চে ল্যান্ড করেছি, রে রে করে তেড়ে এল সনু।

“তুত বোকা। এখানে বসছিস কেন? ট্রেনে বসে যতো ইচ্ছে ঘুমো না। পুরো দেড় ঘন্টা হাতে পাবি”।

“ট্রেনে বসতে দেবে বুঝি এখন?”

“কেন দেবে না? সেখানেই তো যাচ্ছি আমরা। এখুনি গিয়ে বসতে না পারলে অফিস টাইমের  ভিড়ে তোর এই টিংটিঙে শরীরটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না”।

অপমানটা ইগনোর করে চোখ বন্ধ রেখেই এক পা এগিয়েছি কি না এগিয়েছি, কানে ভেসে এল সাংঘাতিক পরিচিত এক বজ্র নির্ঘোষ।

“একি —-, বলা নেই কওয়া নেই চলে যাচ্ছ যে বড়? তোমার স্যুটকেসটা কে বইবে? তোমার কি একার ঘুম পেয়েছে নাকি?”

মায়ের গলায় ঘুমটাও চমকে পালাতে পথ পায় না।  ঠিক তক্ষুনি পাশ থেকে মুশকিল আসান দিদার ভরসা বাণী ভেসে এল -“আহা। কেন এরকম করছিস মেয়েটাকে? দেখছিস চোখ খুলতে পারছে না। এতোগুলো  লোক রয়েছে এখানে , কেউ নিয়ে নেবে ওরটা। তোর সবসময় এত শাসন!”

ওঁরা মা আর মেয়ে যা পারেন ফয়সালা করুন, আমি আমার পুঁচকে স্যুটকেসটা নিয়ে অকুস্থল পরিত্যাগ করাই সমীচীন মনে করে হু হু হাঁটা লাগাই।

ট্রেনে উঠে পড়েছি বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। জানলার ধারে জম্পেশ করে বসে ফুরফুরে হাওয়ায় জীবনটা যে খুব কঠিন সংগ্রাম সেই রাশভারী ফিলিংটা যখন অলমোস্ট মহাশূন্যে বিলীন হব হব  স্টেটে, ঠিক সেই মোক্ষম মোমেন্টে একটা  হৃদয় বিদারণকারী চেঁচামেচি এল কানে।

মিনমিনে এক পুরুষস্বর ছাপিয়ে শুনতে পেলাম মায়ের গম্ভীর আশ্বস্ত গলা “ এটা কিরকম কথা বলছেন আপনারা? আমাদের দেখে কি এত ইরেস্পন্সিবল বলে মনে হচ্ছে?”

ওপাশ থেকে ব্যাকুল প্রতিবাদ হল “ না না ছি ছি। জাস্ট ভাবছিলাম যদি কোনও ভুল হয়ে গিয়ে থাকে। কিছু মনে করবেন না বউদি। কি যে হল। কোথায় যে গেলো”।

আমার ঘুম ভীষণ আদুরে। এত হইহট্টগোলে থাকবার পাত্রই সে নয়। অগত্যা ঝাড়াঝুড়ি দিয়ে উঠে বোঝা গেলো কেসটা।

ওই যে উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে একটু পরেই আসবে যশোবন্তপুর- হাওড়া এক্সপ্রেস, ওটাতে করেই যাবেন ভদ্রলোকেরা, কিন্তু গোলমাল হয়েছে কি, ওনাদের একটা লাগেজ মিসিং। সেই কারণেই এই জিজ্ঞাসাবাদ।

হাতের গরম চায়ে আরামের চুমুক দিয়ে মা বললেন “কোনও মানে আছে? এতো বেখেয়ালি লোকজন আজকাল”।

মিনিট কুড়ি চলে গেল আরও। যশোবন্তপুর- হাওড়া এক্সপ্রেস হুইসিল দিচ্ছে, এদিকে আমাদের ট্রেনও ছাড়ে ছাড়ে , হঠাতই এযাবৎকাল  নেগলেকটেড বাঙ্কটার দিকে চোখ পড়ায় আতংকে নীল হয়ে গেলেন মা।

“ একি, এই স্যুটকেসটা কাদের? এই বিচ্ছিরি নোংরা কাভার পরানো? এটা তো আমাদের নয়”!

কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের ভেতরেই বিটার রিয়েলাইযেশনটা স্ট্রাইক করল তাঁকে। অতঃপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পরিত্রাহি চিৎকার “ শুনছেন? বলি এই যে শুনছেন? এটা কি আপনাদের —-?”

থ্যাংক ইউ আর স্যুটকেস বিনিময়ের মাঝেই লজ্জারুণ কণ্ঠে মায়ের ঘোষণা “কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমার মেয়েটা ঘুমের ঘোরে এটাকেই নিজের মনে করে…”

“না না এরকম তো হতেই পারে। বাচ্চা মেয়ে। জিনিসটা যে পেলাম এটাই অনেক! ওকে কিন্তু বকবেন না! কি সুইট”!

দুটো ট্রেনই ছেড়ে দেওয়ায় অসমাপ্ত থেকে যায় দুপক্ষের কথা।

রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তখন আমার! কি করে জানলেন মা যে ওটা আমিই এনেছি? অন্তত পক্ষে বিয়াল্লিশটা পোঁটলা পুটলি ছিল সবার মিলিয়ে। কথা নেই বার্তা নেই সব দোষ শুধু আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া! চিরকাল এটাই করে আসছেন মা!

কিছু বলতে গেলেই এক কথা “ অন্যকে কেন বলব? আমার নিজের মেয়ে থাকতে?”

দুর্দান্ত লজিক!

কিন্তু ধাক্কাটা এল অন্য দিক থেকে, যখন আমার মিতভাষী বাবা মিটিমিটি হেসে বলে উঠলেন “জানি তোর মা অনেক সময়ই অকারণে কি সামান্য কারণে একটু আধটু বকাবকি করেন। কিন্তু মা বিশ্বাস কর, এবারের কীর্তিটা একেবারে তোর ট্রেড মার্ক! কোনও প্রমাণ সাবুদের দরকার নেই! এ কাজ আমার মেয়ে ছাড়া আর কারুর দ্বারা হতেই পারে না”!

তারপর আর কি?

চারদিকের উচ্চকিত হাস্যরোল থামলে কোলে গুঁজে দেওয়া আদরের নাতনির মাথায় হাত বুলোতে  বুলোতে স্বভাবসিদ্ধ মধুঢালা সুরে তাঁর মেয়েকে বলেন দিদা “তখনই বলেছিলাম এত শাসন করিস না আমাদের লক্ষ্মী মেয়েটা কে”!

 

 

8 Comments

Add yours →

  1. Truly, ki sweet😊

    Like

  2. এইসব টুকর ঘটনা/গল্প গুলোর মধ্যে যে কত চেনা-অচেনা চরিত্র এবং তাদের বৈশিষ্ট ধরা পড়ে, এবং লেখার স্টাইলে/গুণে পুরোটা বেশ সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। মনে হয় আমিও বুঝি ওই ঘটনার কোন এক চরিত্র…

    খুব ভাল লাগল।

    Like

  3. Indranidi……..I almsot read all of your write ups. I must say that you always write so well but your writing is definitely attaining a different height with time. Just love to read you:-) keep it up!!

    Like

Leave a comment